জেলা পরিষদের ক্রমবিকাশ

শতাব্দির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জেলা পর্যায়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসাবে ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড, ডিষ্ট্রিক্ট কাউন্সিল, জেলা বোর্ড ইত্যাদি নামে পরিচিত হয়ে আজকের জেলা পরিষদ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন প্রবর্তনের ফলে জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয় এবং রাজস্ব আদায়ের ভার ও গ্রামের শান্তি-শৃংখলা রক্ষার ভার এদের উপর অর্পিত হয়। এই পদ্ধতিকে একরকম স্থানীয় সরকার হিসাবে গণ্য করা যায়।

স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ১৮৭০ সালে চৌকিদারী পঞ্চায়েত আইন প্রবর্তিত হয়। পঞ্চায়েতের প্রধান কাজ ছিল কর আদায় ও আইন-শৃংখলা রক্ষা করা। পঞ্চায়েত সদস্যরা সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন।

১৮৭৯ সালে লর্ড মেয়র প্রস্থাবিত বেংগল রোর্ড সেস এ্যাক্ট পাশ হয়। এটাই জেলা পর্যায়ে সর্ব প্রথম স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এর প্রধান কাজ ছিল সেসের হার নির্ধারণ, আয় ও ব্যয়ের উদ্দেশ্য নিরূপন। এই কমিটি সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনে কাজ করত।

১৮৮৫ সালে বেংগল লোকাল সেলফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্ট আইন পাশ হয়। এই আইনে তিনস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় স্বায়ত্বশাসিত সরকার গঠিত হয় ঃ ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড, লোকাল বোড ও ইউনিয়ন কমিটি। প্রতিটি জেলায় ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড গঠিত হয়। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট বোর্ডের পদাধিকার বলে সদস্য এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। বোর্ড তিন বছরের জন্য গঠিত হত। ভাইস চেয়ারম্যান সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হতেন। ১৮৮৬ সালে ডিষ্ট্রিক্ট সেস কমিটির তহবিল এবং কার্যক্রম বোর্ডের অধীনে চলে যায় এবং কমিটির বিলুপ্ত ঘটে। যদিও এই আইনে বোর্ডের সদস্যদের নির্বাচনের নিয়ম ছিল, কিন্তু সকল সদস্যই মনোনীত হতেন এবং ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট সকল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

১৯১৯ সালে ‘বেংগল ভিলেজ সেলফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্ট’ পাশ হয়। এই আইনে ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ড, লোকাল বোর্ড ও ইউনিয়ন বোর্ড নামে তিনস্তর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। ১৯২০ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচনের অনুমতি দেওয়া হয়। এ সময় ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের কার্যক্রম ছিল যোগাযোগের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ও পয়ঃ প্রণালী, পানি সরবরাহ, জন্ম-মৃত্যুর রেজিষ্টার সংরক্ষণ, দাতব্য চিকিৎসালয় ও ডাকবাংলো সংরক্ষণ। পূর্বের আয়ের উৎসের সঙ্গে ফেরী ব্যবহারের জন্য ফি আদায় এবং মোটরযানের উপর ট্যাক্সের আয়ের অংশ ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডকে দেয়া হ’ত।

১৯৬৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের সকল নির্বাচন পরোক্ষ ছিল। ১৯৩৬ সালে ‘বেংগল লোকাল সেলফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্ট ১৮৮৫’ সংশোধিত হল। লোকাল বোর্ড বিলুপ্ত করা হয়। এই সংশোধনে দুই তৃতীয়াংশ সদস্য নির্বাচিত এবং এক তৃতীয়াংশ সদস্য মনোনীত হতেন। মনোনীত সদস্যের মধ্যে সরকার ও বেসরকারী সদস্যও ছিলেন। ভোটদাতাগণের বয়স ২১ বছর এবং তাকে স্থানীয় বাসিন্দা হতে হতো। তাকে ৮ আনা সেস ও ৬ আনা চৌকিদারী ট্যাক্স দিতে হতো এবং তার শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হতো। মহিলাদের জন্য ভোট দেয়ার ব্যবস্থা ছিল না। এই ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল।

পাকিস্থান শাসনামলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠাণের সার্বজনীন ভোটের ব্যবস্থা করা হয়। এই বিষয়ে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং কমিটি ১৯৫৬ সালে রিপোর্ট পেশ করেন। কিন্তু এর বাস্থবায়নের পূর্বেই দেশে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়।

১৯৫৯ সালের ‘বেসিক ডেমোক্রসি অর্ডার’ এর মাধ্যমে তৃতীয় বারের মতো স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়। ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের নাম হলো জেলা কাউন্সিল। এই কাউন্সিল ১৯৬২ সাল পর্যন্ত সরকারী কর্মচারী ও নিয়োগকৃত সদস্যদ্বারা পরিচালিত হতো। জেলা প্রশাসক জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতেন এবং বেসরকারী সদস্যরা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করতেন। এই অর্ডারে জেলা কাউনিন্সলের কর্মসূচী ব্যাপক। কিছু কাজ ছিল বাধ্যতামূলক ও কিছু কাজ ছিল ঐচ্ছিক। আবশ্যক কার্যের সংখ্যা ছিল ২৮টি এবং ঐচ্ছিক কার্যের সংখ্যা ছিল ৭০টি। সরকারী অনুদান ছাড়াও কর, টোল, ফি ইত্যাদি ২৯টি উৎস থেকে আয়ের মাধ্যমে কাউন্সিল তহবিল গঠন করা হতো। কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন ৫০% সরকারী অফিসার, ২৫% নিয়োগকৃত প্রতিনিধি, ২৫% চেয়ারম্যান ইউনিয়ন কাউন্সিল ও টাউন কমিটি। এই কাউন্সিল ডিষ্ট্রিক্ট বোড কমিটির চাইতেও সাংগঠনিকভাবে অগণতান্ত্রিক ছিল। এরপর ১৯৬২ সালে ৫০% নির্বাচিত ও ৫০% সরকারী সদস্য করা হয়। নির্বাচনের সকল ক্ষেত্রই পরোক্ষ ছিল। সকল ক্ষেত্রেই ডেপুটি কমিশনার চেয়ারম্যান হিসাবে প্রধান ভূমিকা পালন করতেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্বের ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ১৯৭২ সালে ৭নং অধ্যাদেশ জারী করেন। এই আদেশে জেলা কাউন্সিলের নাম করন হয় জেলা বোর্ড। ডেপুটি কমিশনার বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্য ছিলেন। জেলা প্রশাসনের নিয়োগকৃত পল্লী উন্নয়ন সহকারী পরিচালক জেলা বোর্ডের সচিবের দায়িত্ব পালন করতেন।

১৯৭৬ সালে স্থানীয় সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে জেলা বোর্ডের নাম করা হয় জেলা পরিষদ। এই অধ্যাদেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকলেও অধ্যাদেশ জারী হওয়ার পর প্রকৃত কোন নির্বাচন হয়নি। সুতরাং পূর্বের নিয়মেই এই পরিষদ চলতে থাকে।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পূনর্গঠিত করার জন্য সামরিক সরকার ১৯৭৬ সালে লোকাল গভর্ণমেন্ট অধ্যাদেশ জারী করেন। ইউনিয়ন পরিষদ, থানা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ এই তিনস্থর বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার গঠিত হয়। পরিষদের সদস্যগণ ছিলেন নির্বাচিত, সরকারী ও মহিলা। ১জন চেয়ারম্যান ও ১জন ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। পরিষদের কার্যকাল ছিল ৫ বছর। তুলনামূলকভাবে এই অধ্যাদেশ পূর্বের চাইতে গণতান্ত্রিক ছিল। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ার কারণে অধ্যাদেশের বিধিগুলি বাস্তবায়িত হয়নি। সেজন্য জেলা পরিষদ কোন দিক থেকেই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেনি।

১৯৮৫ সালে জেলা পরিষদের ভবিষ্যত সম্পর্ক ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব লোকাল গভর্ণমেন্ট একটি কর্র্মশিবির অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে ১৯৮৬ সালে জেলা পরিষদ গঠনের জন্য সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রশাসনিক পূর্ণগঠন কমিটিকে জেলা পরিষদের ভবিষ্যৎ দিক নির্দেশনার দায়িত্ব দেয়া হয়।

১৯৮৮ সালের স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন পাশ হয়। এই আইনে জেলা পরিষদের আবশ্যিক কার্যাবলী ১২টি এবং ঐচ্ছিক ৬৯টি এবং আয়ের উৎস মাত্র ৮টি উল্লেখ করা হয়েছে।

১৯৮৮ আইনে ৩টি পার্বত্য জেলা বাদে অবশিষ্ট ৬১টি জেলায় জেলা পরিষদ গঠিত হয়। এই আইনে সরকার চেয়ারম্যান মনোনীত করতেন। পরিষদের সদস্য ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা, মনোনীত সদস্য ও মনোনীত মহিলা সদস্য। মনোনীত চেয়ারম্যানগণকে ডেপুটি মিনিষ্টার এর পদমর্যাদা দেয়া হয়। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ব্যবস্থা ছিল।

১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের সরকারের পতন ঘটে। সরকারের পতনের মন্ত্রণালয়ের ১০-১২-৯০ ইং তারিখের প্রজেই-৪/জেপ-৫০/৯০/১৯০৪ নং স্মারকে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইন, ১৯৮৮ (১৯৮৮ সনের ২৯ নং আইন) এর ১১নং ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার জেলা প্রশাসকগণকে স্বস্ব জেলায় জেলা পরিষদের অস্থায়ী চেয়ারম্যান মনোনীত করে প্রজ্ঞাপন জারী করেন। এই ব্যবস্থা ১৯৯১ সনের জুন মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকে।

মন্ত্রণালয়ের ১৩-৬-৯১ তারিখের প্রজেই-৪/জেপ-৫০/৯০/৭৩৯(৬১) স্মারকের আদেশে জেলা প্রশাসকগণকে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব হতে অব্যহতি দান করে স্ব স্ব জেলা পরিষদের সচিবগণকে চেয়ারম্যান নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত জেলা পরিষদের দৈনন্দিন কাজ পরিচালনার জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের ২১-০৮-৯১ তারিখের প্রজেই-৪/জেপ-১৮/৯১/১৩৯(১২২) স্মারকে জেলা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রকল্পের ঠিকাদারের এবং অন্যান্যদের পাওনা বিল পরিশোধের জন্য জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘‘পাওনা বিল পরিশোধ কমিটি” গঠন করা হয়। অন্য ২ জন সদস্য ছিলেন সচিব, জেলা পরিষদ এবং সহকারী প্রকৌশলী, জেলা পরিষদ।

৯-৮-৯৪ তারিখের প্রজেই-৪/বাজেট-১/৯৩/৯৫৫ স্মারকে মন্ত্রণালয় ইতোপূর্বে জারীকৃত পাওনা বিল পরিশোধ কমিটি বাতিল করে জেলা পরিষদের সচিবগণকে পাওনা বিল পরিশোধ করার ক্ষমতা অর্পন করেন।

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপন নং – ৪৬.০৪২.০৩৩.০৩.০০.১৪৭.২০১১.৪১৭৩, তাং- ১৫/১২/২০১২খ্রি. মোতাবেক ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।

জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ অনুযায়ী প্রথম নির্বাচনের মাধ্যমে ০১জন চেয়ারম্যান ও ২০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত নির্বাচিত পরিষদের মাধ্যমে গত ২২/০১/২০১৭ হতে ১৩/০৪/২০১৭ তারিখ পর্যন্ত জেলা পরিষদের সকল কার্যাবলী সম্পাদিত হয়েছিল।

স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপন নং-৪৬.০০.০০০০.০৪২.১৮.০০৭.২২.৬৪৬, তারিখঃ ২৭ এপ্রিল ২০২২ মূলে সরকার প্রত্যেক জেলা পরিষদে একজন করে প্রশাসক নিয়োগ করেন। এছাড়া স্থানীয় সরকার বিভাগের স্মারক নং-৪৬.০০.০০০০.০৪২.১৬.০০১.১৯.৭২১, তারিখঃ ৩০ মে ২০২২ মূলে গঠিত কমিটি কর্তৃক জেলা পরিষদের সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছিল।

বর্তমানে জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০২২ অনুযায়ী ১জন নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জেলার মোট উপজেলার সমসংখ্যক নির্বাচিত সদস্য, এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, ক্ষেত্রমত, সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ দ্বারা জেলা পরিষদের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।